২০০৯ সালে দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে বলে দাবি সরকারের। কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার জন্য দেশে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে প্রায় সাত হাজার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসবের বেশির ভাগই নামসর্বস্ব। মানহীন কারিগরি শিক্ষায় বাড়ছে না দক্ষ জনশক্তি। ফলে বিদেশের শ্রমবাজারও সেভাবে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। আবার দেশের কারিগরি শ্রমবাজারের উচ্চ পদগুলোয়ও আধিপত্য বিদেশিদের। এ ছাড়া সাধারণ স্কুল-কলেজে কোনো ট্রেড কোর্স না থাকায় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেও শূন্য দক্ষতায় থেকে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার দ্বিগুণের ঘোষণা দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সরকারি পলিটেকনিকগুলোয় আসনসংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়। পাশাপাশি দেশের ৬৪টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজকে পলিটেকনিক কলেজে উন্নীত করা হয়। কিন্তু আড়ালে পড়ে থাকা বেসরকারি পলিটেকনিকগুলো নিয়ে সবাই উদাসীন।
কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে গঠিত হয়েছিল কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। বর্তমানে এই বোর্ড চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন অ্যাগ্রিকালচার, ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল, ডিপ্লোমা ইন ফিশারিজ ও ডিপ্লোমা ইন জুট টেকনোলজি কোর্স; তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন হেলথ টেকনোলজি ও ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি, দুই ছর মেয়াদি দাখিল এবং ভোকেশনাল কোর্স অনুমোদন ও পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এ ছাড়া কর্মমুখী শিক্ষা, বিশেষ করে তিন মাস, ছয় মাস ও এক বছর মেয়াদি বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে এই শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখে বের হচ্ছে, বোর্ড তার কোনো খোঁজখবর রাখে না।
অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ও কর্মমুখী শিক্ষার সার্টিফিকেট দেয় কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এসব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও নেই। ফলে মানহীন এসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনলেও দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
দেশে ৪৬১টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থাকলেও মোটামুটি ভালোমানের ৩০টি। বাকি চার শতাধিক প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে সংশয় খোদ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তাদের। পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর মান তদারকিতে ব্যর্থ হওয়ার পরও নতুন করে প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। গত এক বছরে অনুমোদন পেয়েছে ৩০টি নতুন বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
বোর্ডের নীতিমালায় রয়েছে, একটি পলিটেকনিকের জন্য ১৫০ থেকে ২০০ বর্গফুটবিশিষ্ট ৯টি সাধারণ কক্ষ, প্রতিটি টেকনোলজির জন্য চারটি শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষকদের বসার জন্য দু’টি পৃথক কক্ষ, পদার্থ ও রসায়নের জন্য ২০০ বর্গফুটের জন্য দুটি পৃথক কক্ষ থাকতে হবে। এ ছাড়া সিভিল/আর্কিটেকচার কোর্সের জন্য ৪০০ থেকে ৬০০ বর্গফুটের ১০টি ল্যাবরেটরি/ওয়ার্কশপ, মেকানিক্যাল টেকনোলজির জন্য ৪০০ থেকে ৬০০ বর্গফুটের আটটি, ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজির জন্য ছয়টি, ইলেকট্রনিকস টেকনোলজির জন্য পাঁচটি, কম্পিউটার টেকনোলজির জন্য ছয়টি, পাওয়ার টেকনোলজির জন্য পাঁচটি পৃথক ল্যাবরেটরি/ওয়ার্কশপ থাকতে হবে। কিন্তু দেশের পলিটেকনিকগুলোর বেশির ভাগেরই নীতিমালা অনুযায়ী অবকাঠামো সুবিধা নেই।
এশিয়ার মধ্যে দ্রুত উন্নতি করা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার উন্নয়নের প্রধান শর্ত হিসেবে ধরা হয় কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন। সিঙ্গাপুরে এই শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ ও মালয়েশিয়ায় ৪০ শতাংশ। যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও এই হার ৫৮ শতাংশের মধ্যে। ফলে এসব দেশের মানুষের বার্ষিক আয় সাত হাজার থেকে ৪২ হাজার ডলারের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার সরকার ১৪ শতাংশ দাবি করলেও বাস্তবে তা অনেক কম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আমাদের দেশের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও নার্সদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। কিন্তু মানহীন কারিগরি শিক্ষার কারণে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না। ফলে বিদেশের চাকরির বাজারও ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
জানা যায়, দক্ষতা না থাকায় কারিগরি শিক্ষার্থীরা নিজের দেশের শ্রমবাজারেও ঢুকতে পারছে না। বাংলাদেশের পোশাক কারখানা, টেক্সটাইল, বায়িং হাউসসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১২ থেকে ১৫ হাজার বিদেশি কাজ করছে। পোশাক ও টেক্সটাইল খাত বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প হলেও এসব খাতের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির বিষয়টি তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি কখনোই।
জানা যায়, সরকারি ৪৯ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রকৃত আসনসংখ্যা ১২ হাজার ৫২৮টি। চাহিদা বিবেচনা করে শিক্ষক না বাড়িয়েই প্রতিটি পলিটেকনিকে ডাবল শিফট করা হয়েছে। ওদিকে ৬৪টি সরকারি কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং বগুড়া ভোকেশনাল টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স খোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে চলতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে প্রায় ৪৮ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে শিক্ষকের অভাবে ঠিকমতো ক্লাসই করাতে পারছে না কিছু প্রতিষ্ঠান। আর ব্যবহারিক ক্লাস এসব শিক্ষার্থীর কাছে যেন দুঃস্বপ্ন। এ অবস্থায় সার্টিফিকেট নিয়েও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা অদক্ষই থেকে যাচ্ছে।
এসব বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ৮৭টি প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করা হয়েছে। বেশির ভাগের জবাব আমরা পেয়েছি। যাচাই-বাছাই শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া আমরা কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ-সুবিধা ও মান অনুযায়ী ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ -এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছে, তা নিজেরাই বুঝতে পারবে। আগে আমাদের চিন্তায় ছিল- আগে প্রতিষ্ঠান তারপর কোয়ালিটি। এখন নীতিমালা অনুযায়ী অবকাঠামো ছাড়া অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না।
-লেখকঃ আনিসুর রহমান এরশাদ
কন্ট্রিবিউটর, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস