স্বপ্ন জয়ের পিছনের গল্প
ভাই যতই ফুটানি মারি অতীতকে ভুলে যেতে পারব না। গত বছর এই সময়ে এমনও দিন গেছে সারাদিন ইন্টার্ভিউ দিতাম আর সকালবেলা সবগুলো কোম্পানি থেকে রিজেকশন ইমেইল পেতাম। মিথ্যা বলব না, আমি কোনদিনও ভাল প্রোগ্রামার ছিলাম না, বিশ্বাস না হলে আমার টিচার বা ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। প্রোগ্রামিং কম্পিটিশন তো দূরের কথা, এসাইনমেন্ট ও বন্ধুদের হেল্প নিয়ে করতাম। কিন্তু প্রোগ্রামিং এর এই দুরবস্থা থেকে কিভাবে এই পর্যন্ত আসতে পারলাম! কি কি করেছি, শুনবেন?
১। বন্ধুঃ পলিটেকনিক থেকে একদল বন্ধু মিলে ঢাকায় আসি ডুয়েট ভর্তি কোচিং করতে। যখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ি তখন আমেরিকায় হায়ার স্টাডির জন্য প্রস্তুতি নেই রুমমেট বা বন্ধুদের সাথে। অতঃপর আমেরিকায় এসে বিগটেকের স্বপ্ন দেখা পিএইচডির ভাই ব্রাদারদের কাছেই। মোটকথা আমার জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত গুলোর অনুপ্রেরণা পাই বন্ধুদের কাছে।
২। কলিজাঃ নিশ্চিত ব্যর্থতা জেনেও আপনি যখন বড় কিছু অর্জন করতে চাইবেন তখন একটা জিনিসই লাগবে তা হল Courage। আপনি প্রোগ্রামিং এ ভাল না এটা জেনেও বিশ্বসেরা ইঞ্জিনিয়ারদের পিছনে ফেলে টপ কোম্পানিতে জব পেতে চাইবেন। চাইতেই পারেন, কিন্তু বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব। তার জন্য অনেক বড় রিস্ক নিতে হবে আপনাকে। গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই বলেন, “আমি দেখতে চাই তরুণরা ক্রিয়েটিভিটিতে অনেক ফোকাস করবে এবং বেশি বেশি রিস্ক নিবে”। আল্লাহ মাফ করুক নিজের গুণগান গাইব না শুধু বোঝার জন্য বলছি, পলিটেকনিক থেকে ডুয়েট, ডুয়েট থেকে আমেরিকায় পিএইচডি, অতঃপর মেটা। এতদূর আসতে হয়তো আমার সময় লেগেছে অনেক কিন্তু এটা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে লাইফে রিস্ক নিতে হয়। জীবনের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে যে অপশনটি সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল সেটি এক্সেপ্ট করেছি এবং বারবার ব্যর্থ হয়েছি।
৩। ধৈর্যঃ সবচেয়ে বেশি হোঁচট খেয়েছি যখন Leetcode/CodeChef/HackerRank এ প্রবলেম সলভিং শুরু করলাম। সিএসই স্টুডেন্ট কিন্তু Hashmap জানে না হয়ত এমন কাউকে পাবেন না, কিন্তু Hashmap দিয়ে কিভাবে problem solve করতে হয় এটা কয়জন জানে! আমিও জানতাম না। BFS/DFS -র নাম শুনে নাই এমন কে আছে। প্রায় সব ইন্টার্ভিউতেই BFS/DFS থেকে প্রশ্ন থাকে কিন্তু কয়জন ক্র্যাক করতে পারে! আমিও পারি নাই।
তাই একদিকে যেমন বেসিক ঝালাই করা শুরু করলাম অন্যদিকে ইজি প্রবলেম দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। হতাশ হয়ে যেতাম যেদিন শত চেষ্টা করেও ১টি ইজি প্রবলেম সলভ করতে পারতাম না। নিরাশ হয়ে কোডিং পার্টনারকে বলতাম, ভাই আমাকে দিয়ে মনে হয় হবে না? বেচারা সাহস দিয়ে বলত “ভাই, সময় লাগবে। লেগে থাকেন, আপনি পারবেন”। যাইহোক, নিজে না পারলে ডিসকাশন সেকশনে গিয়ে বেস্ট সল্যুশনটা বোঝার চেস্টা করতাম, নিজেও বুঝতে না পারলে ইউটিউব দেখে চেষ্টা করতাম। Always whiteboard বা Google doc এ কোড লিখতাম। স্যাম্পল ইনপুট আউটপুট দিয়ে ম্যানুয়ালি কোড রান করাতাম। সব ঠিকঠাক থাকলে, কোড সাবমিট করতাম। দীর্ঘ দুই মাস এভাবে চলার পর আবিষ্কার করলাম যে আমি নিজে নিজেই সলভ করতে পারি। কনফিডেন্স বেড়ে গেল, স্পিডও বাড়ল। একে একে Array, hashmap, linked list, stack/Q, string, BFS/DFS, two pointers, searching/sorting, dynamic programming ইত্যাদির ১০ থেকে ১৫ টি করে problems solve করলাম। সেই সময়ে দুইটি বই খুব কাজে দিত ১) Grokking Coding Interview Patterns by Educative ২) Cracking the Coding Interview। এরপর লিটকোডে Top Interview Questions নামে একটা লিস্ট আছে ওখান থেকে শখানেক প্রবলেম সলভ করলাম এবং question এর ফ্রিকুয়েন্সি অনুযায়ী কোম্পানি ওয়াইজ লিস্ট বানাতাম। যেমনঃ মেটাতে এর আগে কি কি question বেশি জিজ্ঞেস করা হয়েছে। Amazon বা Google এ কিকি ইত্যাদি। এবং এগুলা সল্ভ করতাম।
৪। ফ্লুয়েন্সি: কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ানোর জন্য কোডিং পার্টনারদের সাথে মক ইন্টার্ভিউ দিতাম।Pramp ডট কমে গিয়ে ফ্রি Mock দিতাম। পরিচিত যারা বিগটেকে জব করতেন, তাদের অনুরোধ করতাম। যেমন তারেক ভাই (তখন মেটায় ছিলেন, এখন Walmart lab এ) আমার একটা মক ইন্টার্ভিউ নিয়েছিলেন। আল্লাহ ভাইয়ের মঙ্গল করুক।( ইন্টার্ভিউয়ের ভিডিও লিংক কমেন্টে)
৫। কনসিস্টেন্সিঃ যে কোন স্কিল শার্প রাখার জন্য রেগুলার প্র্যাকটিস করতে হয়। চাকুতে ধার না দিলে যেমন চাকু ভোতা হয়ে যায় তেমনি প্রতিদিন প্রবলেম সল্ভিং না করলে ধার নষ্ট হয়ে যায়। তাই রেগুলার প্রাকটিসের পাশাপাশি আরও একটা কাজ করতাম তাহল নিজের স্কিল যাচাইয়ের জন্য মাঝে মাঝে লিটকোডে মান্থলি/বাইউইকলি coding competition এ অংশ নিতাম।
৬। নেটওয়ার্কিংঃ সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল ইন্টার্ভিউ কল পাওয়া। এর জন্য আমি ৩টি কাজ করেছি ১) প্রতিটি জবে এপ্লাই করার আগে রিজুমি আপডেট করতাম ২) লিঙ্কডইনে নেটওয়ার্ক বাড়াতাম ৩) রেফারেলের মাধ্যমে জবে এপ্লাই করতাম। সবচেয়ে বেশি ইন্টার্ভিউ কল পেয়েছি লিঙ্কডইনের মাধ্যমে।(বিস্তারিত কমেন্টে)
৭। স্ট্যামিনা: ফোন ইন্টার্ভিউ পাশ করতে পারলে আপনাকে ডাকা হবে অনসাইট ইন্টার্ভিউয়ের জন্য যেখানে একটানা ৫-৭ রাউন্ড ইন্টার্ভিউ হবে। প্রতিটি রাউন্ড ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা। একটানা ৫-৬ ঘণ্টা কেমনে ইন্টার্ভিউ দিবেন? ব্রেইনকে কিভাবে দ্রুত কাজ করাবেন? রিজেকশন থেকে যে স্ট্রেস তৈরি হবে, তা কিভাবে দূর করবেন? এর জন্য বেশি কিছু করতে হবে না, প্রতিদিন সকালে আধা ঘন্টা হাটা বা দৌড়ানো আমার জন্য যথেষ্ট ছিল।
৮।Rejections: ইন্টার্ভিউ যত না কঠিন, রিজেকশন মেনে নেয়া ছিল তার চেয়েও কঠিন। মুহুর্মুহু রিজেক্টশন। Uber, LinkedIn, Intel, Tesla এমন কোন কোম্পানি নাই যে আমাকে রিজেক্ট করে নাই। এত বেশি ব্যর্থতা যে আপনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবেন। কাউকে বলতে পারবেন না, একাই হজম করতে হবে, এবং পরের দিন আবার ফ্রেশ স্টার্ট করতে হবে। সুন্দর পিচাইয়ের একটা কথা বারবার মনে করতাম “যে জিনিস অর্জন করতে গিয়ে আপনি বার বার ব্যর্থ হন নাই, সেটি যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী ছিল না”। আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জে এফ কেনেডির একটা কথা আছে “যারা খুব খারাপভাবে ব্যর্থ হওয়ার সাহস দেখায়, তারাই অনেক কিছু অর্জন করতে পারে”। আমাদের সিইও মার্ক জাকারবার্গের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে “সবচেয়ে বড় সাফল্য তখনই আসে যখন ব্যর্থ হওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে”।
ফেসবুকে জব পেয়ে আমি সফল কি না জানি না। তবে স্বপ্ন পূরণ করাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এবং সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতে পারাটা যে কি আনন্দের ছিল তা লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব না!!! সবার স্বপ্নই বড় থাকে কিন্তু পার্থক্য করে দেয় শুধু স্বপ্ন জয়ের পদ্ধতি।
আমার মত হয়ত অনেকেই জবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কেউবা বিদেশে হায়ার স্টাডির চেষ্টা করছেন। কেউ হয়ত বিসিএস প্রিপারেশন নিচ্ছেন বা কেউ একটা বিজনেস দাড় করানোর চেষ্টা করছেন। মনে রাখবেন আজকে আপনি যে শ্রম দিচ্ছেন তার ফলাফল যদি সাথে সাথেই পেতে চান তবে ধরে নিবেন আপনি বেশি দূর যেতে পারবেন না। আমার পিএইচডির প্রফেসর ড. আনন্দ মন্ডল প্রায়ই বলতেন, “দেখ আব্দুল্লাহ, সফল হওয়ার কোন শর্টকার্ট নাই”। শুরুতে আপনার হয়তো অনেক কষ্ট হবে কিন্তু যদি ধৈর্য ধরে লেগে থাকেন তাহলে বহুগুণে এর রিটার্ন পাবেন। স্বপ্নকে অনেক বড় করেন, আপনার যোগ্যতা বা সামর্থ্য এর বাইরে চেষ্টা করেন, ফলাফল আপনাকে অবাক করে দিবে। বিগটেক টার্গেট করেছিলাম, গুগলে জব পাইনি কিন্তু মেটায় পেয়েছি!”Shoot for the moon. Even if you miss, you’ll land among the stars.”
বাই দ্যা ওয়ে, আজকে মেটায় আমার ১ বছর পূর্ণ হল তাই অতীতকে মনে করতে গিয়ে এই লেখাটা লেখা। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। সবার জন্য দু’আ ও ভালবাসা
Abdullah Al Mamun
Machine Learning Engineer
Meta (Facebook) Headquarter, California, USA
Let everyone know by sharing.
Page Link – bdengineer.com
Page Link- Engineers Job in Bangladesh