ক্লাস টেনের আগে কোনো দিন বুয়েটের নাম শুনিনি
সেন্ট মার্টিনে বেড়ে ওঠা আয়াজ উদ্দিনের কাছে কক্সবাজার সরকারি কলেজকে মনে হতো দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান! এলাকায় আশপাশের কাউকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেখেননি। বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে বেড়ে ওঠা এই তরুণ কেমন করে বুয়েটের ছাত্র হলেন?
সেন্ট মার্টিনে বেড়ে ওঠা আয়াজ উদ্দিনকে সৈকত, সাগর আর টানে না!
ছুটিতে বন্ধুরা দল বেঁধে যেখানে বেড়াতে যায়, আমি সেখানেই থাকি। সেন্ট মার্টিন—আমার জন্মস্থান। আমার দাদা (কালো মিয়া), দাদার দাদা (নেজামত আলী), তাঁদের জন্মও এই দ্বীপে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগে পড়ি। অনেকের হয়তো শুনলে লোভ হবে, গত দেড় বছর অনেক কিছুই যখন স্থবির ছিল, আমি সাগরের খুব কাছাকাছি থেকে অনলাইনে ক্লাস করেছি। আমার কাছে অবশ্য খুব আলাদা কিছু মনে হয় না। ছেলেবেলা থেকে সমুদ্রের গর্জন শুনে ঘুম ভেঙেছে। সৈকত, সাগর, পাথর আর টানে না। শুধু ভরা পূর্ণিমায় চারপাশ যখন আলোকিত হয়ে যায়, মনটা কেমন কেমন লাগে।
দশম শ্রেণিতে ওঠার আগে যেই আমি কোনো দিন বুয়েটের নাম শুনিনি, সেই আমি কেমন করে বুয়েটের ছাত্র হলাম? সে গল্পটাই বলব।
আমার পরিবার –
আমার বাবা ওমর আজিজ পেশায় পর্যটন ব্যবসায়ী। চার মাসের আয়ে আমরা বছরের বাকি আট মাস চলি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি পঞ্চম। স্থানীয় নুরানি মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল। মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে এখানকার জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই। প্রাইমারি পেরিয়ে ভর্তি হই সেন্ট মার্টিন বিএন উচ্চবিদ্যালয়ে। ২০১৭ সালে পুরো দ্বীপের মধ্যে আমরা এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম মাত্র ৩৭ জন। অথচ সে সময় আমাদের ব্যাচই ছিল স্কুলের সবচেয়ে বড় ব্যাচ।
সাগরপারে বড় হওয়া আয়াজ –
স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য আলাদা কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তাই যারা বিজ্ঞানে পড়ত, তাদের টেকনাফে গিয়ে প্রাইভেট পড়তে হতো। টেকনাফ কলেজ, কিংবা কক্সবাজার সরকারি কলেজ তখন আমাদের কাছে বিরাট ব্যাপার। কক্সবাজার সরকারি কলেজকে তো দেশের সেরা কলেজ মনে হতো! ভাবতাম পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় কলেজ আর নেই।
স্কুলে যেহেতু বিজ্ঞান বিভাগেই পড়ব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাই অনেকের মতো আমিও ব্যাগ গোছালাম—টেকনাফ যাব বলে। বিকেলের জাহাজ ধরব। এমন সময় সেদিনই খবর পেলাম, স্কুলে বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক আসবেন। প্রধান শিক্ষক উজ্জ্বল ভৌমিক স্যার খুব স্নেহ করতেন। আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুই টেকনাফ না গিয়ে নতুন স্যারকে তোদের বাসায় রেখে দে।’ নতুন ওই শিক্ষকই ছিলেন আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
১ নম্বরের জন্য!–
তাঁর নাম হামিদুর রহমান। ডাকনাম স্বাধীন। তাই আমরা ডাকতাম স্বাধীন স্যার। চমৎকার পড়াতেন। এক পড়া দ্বিতীয়বার পড়তে হতো না। ছাত্র হিসেবে আমরা মোটামুটি গর্দভ ছিলাম। দশম শ্রেণির শেষের দিকে স্যারের কাছে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়া শুরু করলাম। স্যার যেহেতু আমাদের বাসাতেই থাকতেন, তাই একটু বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলাম। যাহোক, স্যারের সহায়তায় আমি আর আমার এক বন্ধু এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে গেলাম। স্কুলের আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলাম আমরা।
এসএসসির পর ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করতে চলে গেলাম চট্টগ্রামে। তখন বুঝেছিলাম, ইংরেজিতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। চট্টগ্রাম কলেজ বা মহসিন কলেজে পড়ার ইচ্ছা জেগেছিল, কিন্তু মোট নম্বর কম থাকায় সুযোগ পাইনি। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে আমার ঠিকানা হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ‘ভাগ্যক্রমে’ বলছি, কারণ ভিক্টোরিয়া কলেজে সে বছর বিজ্ঞান বিভাগে সর্বশেষ যাকে নেওয়া হয়েছে, তার নম্বর ছিল ১১৩০। আর আমি পেয়েছিলাম ১১৩১!
টমছম ব্রিজ নিউ হোস্টেল
কুমিল্লা গিয়ে পড়ব—পরিবারের কেউ চাননি। তা ছাড়া সেখানে পরিচিত তেমন কেউ ছিলও না। নাসির ভাই নামের একজনকে চিনতাম। তিনি সেন্ট মার্টিন ঘুরতে গিয়ে একবার আমাদের স্কুলে গিয়েছিলেন। আমার এক বন্ধু তাঁর ফোন নম্বর রেখে দিয়েছিল। কী ভেবে সেই নাসির ভাইয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ করলাম, তাঁর বাসায় উঠলাম।
তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন, সেই ঋণ শোধরানোর মতো নয়। যখন তাঁর বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে উঠলাম, তখনো সব সময় খোঁজ রাখতেন। এখনো রাখেন।
কলেজজীবনের শুরুর দিকে হতাশায় পড়ে গিয়েছিলাম। কোথায় এলাম! কিছুই তো পারি না। ভাবছিলাম কলেজ বদলে কক্সবাজার চলে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়নি।
তখন আমি থাকতাম টমছম ব্রিজ নিউ হোস্টেলে (সোহরাওয়ার্দী হল)। কলেজেরই হোস্টেল। এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা অ্যাসোসিয়েশন আছে। অ্যাসোসিয়েশনের ভাইয়ারা প্রায়ই এসে ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত নানা দিকনির্দেশনা দিতেন। তাঁদের কাছেই বুয়েট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। স্বপ্ন দেখি—একদিন আমিও বুয়েটে পড়ব। কিন্তু কলেজে রেজাল্ট খুব যে ভালো ছিল, তা নয়। একাদশ শ্রেণির ফাইনাল আর টেস্ট পরীক্ষা—এই দুটো ছাড়া আর কোনো পরীক্ষায় সব বিষয়ে পাস করতে পারিনি। তাই এইচএসসির ফল নিয়ে খুব ভয়ে ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেলাম জিপিএ ৫।
অতঃপর বুয়েটে
ঢাকায় এসে কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর আরও এক দফা হতাশার মধ্যে পড়লাম। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের দেখে মনোবল একদম কমে গিয়েছিলাম। সবাই কত ভালো ছাত্র, আমি তো সেই তুলনায় কিছুই না! একে তো হতাশা, তার ওপর সাগরপারে বড় হওয়া আমি ঢাকার পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। টানা দেড় মাস জ্বর, ডায়রিয়া লেগেই থাকল। তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, শাবিপ্রবি, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিই। যখন ফল প্রকাশ শুরু হলো, ভীষণ অবাক হলাম। কারণ দেখলাম—অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় আছে আমার নাম। পরীক্ষা ভালো হয়েছিল, কিন্তু এতটা আশা করিনি। বুয়েটে যখন ভর্তি হলাম, আমার চেয়েও খুশি হয়েছিল আমার পরিবার ও দ্বীপবাসী। বিশেষ করে আমার বাবা। আমার এক দূর–সম্পর্কের নানা মৌলভি আবদুর রহমান বাজারে তাঁর হোটেলের সামনে বিশাল এক ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছিলেন।
বুয়েটের ছাত্র আয়াজ
সাগর পেরিয়ে এত দূর আসতে পারার কৃতিত্ব কখনোই আমার একার নয়। আমার সৌভাগ্য, অনেক মানুষের সাহায্য পেয়েছি। আমার পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু…আরও অনেকে। যাঁদের ঋণ কোনো দিন শোধ হওয়া
© স্বপ্ন নিয়ে
Share করে সবাইকে জানিয়ে দিন।
.
PageLink- Engineers Job in Bangladesh
.
Page Link- Diploma Engineers of Bangladesh