
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বৃত্তিসহ লোভনীয় সব সুবিধা দেয়ার কারণে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া হয়ে উঠেছে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর গন্তব্য।
২০২১ ওপেন ডোর রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুসারে, একক গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ৫৯৮ জন বাংলাদেশিকে স্টাডি পারমিট দিয়েছে। এই হার ২০০৯ সালের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। ফরেইন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালটেশনস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফএসিডি-ক্যাব) বলছে, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের বৃত্তি পাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যান্য শীর্ষ গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান। এসব দেশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের টানার জন্য প্রচুর বৃত্তি ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে থাকে।
কিন্তু অভিবাসী হওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশই পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসে না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন। অভিবাসী হওয়া দেশগুলোতে চাকরির সুযোগ, বসবাসের অনুমতি ও উচ্চমানের জীবনযাত্রা পাওয়ার কারণে তারা দেশে ফেরেন না।
পশ্চিমের অনেক দেশেই জন্মহার কমে গেছে। কমতে শুরু করেছে ওসব দেশের জনসংখ্যাও। এ কারণে পশ্চিমা দেশগুলো শিক্ষা অভিবাসনের মাধ্যমে শ্রমঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে বাংলাদেশের বিশাল বেকারত্বের কারণে তরুণরা শিক্ষা অভিবাসনের ক্রমবর্ধমান সুযোগ গ্রহণে উৎসাহিত হচ্ছেন।
সফল অভিবাসীরা প্রায়ই নিজ দেশে বিনিয়োগ করেন, জ্ঞান প্রয়োগ করেন, রেমিট্যান্সও পাঠান। তবু দরিদ্র দেশগুলো থেকে ‘ব্রেইন ড্রেন’ বা মেধা পাচার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একটি উন্নয়নশীল দেশে যখন ব্যাপক হারে শিক্ষা অভিবাসন চলতে থাকে, তার ফলে যে নেতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি হবে, তার প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতিতে।
মেধাবীদের দেশত্যাগের ফলে অর্থনীতিতে আস্থা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ কারণে মানুষ দেশে না থেকে বিদেশে চলে যেতে চাইবে বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও শিক্ষায় দেশের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবাও।
বাড়ছে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা
ইউনেসকোর তথ্যমতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী বিদেশে যায়। ২০২০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা চারগুণ হয়েছে।
ইউনেসকোর তথ্য বলছে, ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি জমায়।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ এই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ব্যাচের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই শিক্ষার্থী বিদেশে চলে যায়। তাদের খুব কমসংখ্যকই দেশে ফিরে আসে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় মেধাবীদের জন্য ভালো চাকরির সুযোগ রয়েছে। তবু তাদের অনেকেই দেশে চাকরি পাওয়ার পরেও কেবল চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিল আফরোজা বেগম।
অন্যদিকে দেশের চাকরির বাজারে ব্যাপক প্রতিযোগিতা থাকায় মাঝারি মেধার শিক্ষার্থীরাও বিদেশে পড়তে যেতে উৎসাহিত হচ্ছে। কারণ পড়া শেষ হলে সেখানে সহজে চাকরি পাওয়া যায়
দেশে ফিরতে চান না সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে বিদেশে থেকে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
শিক্ষকেরা বাইরে যান এমএস, পিএইচডি ইত্যাদি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য। এই স্টাডি ব্রেকের সময় তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাঁচ বছর বেতন পেয়ে থাকেন। এরপর আরও এক বছর অর্ধেক বেতনে ও পরের এক বছর বিনাবেতনে বিদেশে অবস্থান করতে পারেন শিক্ষকেরা।
ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ জন শিক্ষক অবৈধভাবে দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন এবং তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছয় বছর বেতন পেয়েছেন। তারা বিনাবেতনে আরও এক বছর বিদেশে থাকার অনুমতি চেয়ে আবেদনও করেননি। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩।
২০২০ সালে বিনাবেতনে ১০৩ জন শিক্ষক বিদেশে ছিলেন। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬৫ জন।
অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করায় ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সিন্ডিকেট সভায় ৫২ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়।
একই অভিযোগে ১৯৭২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ জন শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১১৮ জন শিক্ষক উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ফিরে এসেছেন কেবল ৩৮ জন।
শিক্ষা অভিবাসনের অন্য দিক
আফ্রিকার মতো বিশ্বের দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে প্রচুর প্রতিভা থাকলেও এসব অঞ্চলে প্রতিভাবানদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়ার এবং তাদের সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগানোর মতো অবকাঠামো নেই।
ব্লুমবার্গে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, দরিদ্র দেশগুলো থেকে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ উদ্বেগের বিষয় হলেও, এর ফলে ei দেশগুলোতে প্রতিভার ঘাটতি কমই হয়।
যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক সফল ভারতীয় থাকায় এর সুফল পেয়েছে ভারতও। তাছাড়া, এরকম অভিবাসনের ফলে দরিদ্র দেশগুলোর শিক্ষার্থীরাও উন্নততর শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাবে।
দেশের ভেতরেও শিক্ষা অভিবাসনের কিছু সমর্থক রয়েছে। মূলত বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও করপোরেশনও এরকম অভিবাসনের সমর্থক।
Source – tbsnews.net
লিখেছেন – কামরান সিদ্দিকী & মীর মোহাম্মদ জসিম